Promo Fest 2025 : ইউনিটি প্রমফেস্টের ক্লোজিং প্রোগ্রাম ঘিরে রাজ্যের সংস্কৃতি ও বিনোদনের যে উৎসবমুখর আবহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা রূপ নিল আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা ও পুলিশের লাঠিচার্জে। জনপ্রিয় শিল্পী জুবিন নটিয়ালকে এক নজর দেখার জন্য এবং তাঁর গান শোনার আশায় হাজার হাজার মানুষ আগরতলার আস্তাবল ময়দানে জমায়েত হন। কিন্তু চরম অব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত পাস বিতরণ এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের সম্পূর্ণ ব্যর্থতার ফলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে, যার জেরে সাধারণ দর্শক, ছাত্র-যুব সমাজ এবং সংবাদকর্মীরা আহত হন। বহু মানুষকে আইজিএম হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে তীব্র ঝড় উঠেছে। সিপিআইএম ও কংগ্রেস নেতৃত্ব পুলিশের ভূমিকা এবং সরকারের সামগ্রিক প্রশাসনিক ব্যর্থতার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে—সংস্কৃতি ও উৎসবের আড়ালে মানুষের মৌলিক সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর সরকারি কৌশল।
সিপিআইএম নেতা অমল চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া ঃ –
সিপিআইএম নেতা অমল চক্রবর্তী এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন কোনও দুর্ঘটনা হিসেবে মানতে নারাজ। তাঁর মতে, প্রমফেস্টে যা ঘটেছে, তা আসলে রাজ্যে শাসক দলের দীর্ঘদিনের উশৃঙ্খল শাসনেরই প্রতিফলন। তিনি বলেন, “আমি শাসক দলের কাছে একটা সরল প্রশ্ন রাখতে চাই—তাদের শৃঙ্খলাটা কোথায়? মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী সভায় চেয়ার ছোড়াছুঁড়ি হয়, মন্ত্রিত্ব নিয়ে মারামারি হয়, মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বলে সোর্স মানি নেই। বিরোধী দলের অফিসে লাঠি হাতে আক্রমণ হয়। এই রাজ্যের শাসন মানেই এখন বিশৃঙ্খলা।”
অমল চক্রবর্তীর বক্তব্যে উঠে আসে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া একের পর এক বিশৃঙ্খলার উদাহরণ। তিনি বলেন, “ক্ষয়িপুর থেকে রামনগর, রামনগর থেকে ভাদারঘাট, ভাদারঘাট থেকে উদয়পুর, আবার বিলোনিয়া—প্রতিটি জায়গায় শাসক দলের কর্মসূচি মানেই বিশৃঙ্খলা। বিলোনিয়ায় গানের উৎসবে পুলিশকে লাথি মেরে মঞ্চ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে যদি পুলিশ নিরাপদ না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হয়, সেটা সহজেই বোঝা যায়।”
প্রমফেস্ট প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “এই উৎসব আলাদা কিছু নয়। শাসক দলের নিজেদের সংগঠনের মধ্যেই উশৃঙ্খলতা রয়েছে, তাদের কর্মসূচির মধ্যেও উশৃঙ্খলতা। মানুষ আজ শাসক দলের কোনও কর্মসূচিতে যেতে ভয় পায়।”
অমল চক্রবর্তী আরও অভিযোগ করেন, এই ধরনের উৎসব আসলে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য পরিকল্পিত। তাঁর ভাষায়, “নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি দেশ চালায় কাজের কথা না বলে, শিক্ষার কথা না বলে, খাদ্যের কথা না বলে। গ্যাসের দাম তিন গুণ, পেট্রোল-ডিজেলের দাম তিন গুণ, ডলার প্রায় সেঞ্চুরি ছুঁইছুঁই—এই প্রশ্নগুলো যাতে মানুষ না তোলে, তাই উন্মাদনা তৈরি করা হয়। প্রমফেস্ট সেই উন্মাদনারই অংশ।”
তিনি বলেন, “আমি গান-বাজনার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তাদেরই আবার লাঠিপেটা করা হচ্ছে—এটা অভূতপূর্ব। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় অনুষ্ঠান করে জনগণকেই মারধর করা হচ্ছে।”
ডিওয়াইএফআই রাজ্য সম্পাদক নবারুন দেব এর প্রতিক্রিয়া ঃ-
এই ঘটনার পর সিপিআইএম নেতা নবারুণ দেবও সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানান। তাঁর বক্তব্য আরও সরাসরি এবং কটাক্ষপূর্ণ। তিনি বলেন, “টিকিট দিয়ে মানুষকে ডেকে এনে লাঠিপেটা—এটা বিজেপি সরকারের নতুন মডেল। তোমরা আসো, আনন্দ করো, তারপর মার খাও।”
নবারুণ দেবের মতে, একজন ভালো শিল্পীর অনুষ্ঠানকে এইভাবে রক্তাক্ত করে তোলা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, রাজনৈতিক অপরাধও বটে। তিনি বলেন, “জুবিন নটিয়াল একজন অসাধারণ শিল্পী, দেশের গর্ব। সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো একজন ক্রীড়াবিদও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু যারা তাঁদের দেখতে এসে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, এতে কি শিল্পীদের সম্মান বাড়ে? না, এতে সরকারের অযোগ্যতাই প্রকাশ পায়।”
তিনি রাজ্যের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে এই উৎসবের তীব্র তুলনা টেনে বলেন, “রেগা শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছেন না, শিক্ষকরা নিয়মিত হচ্ছেন না, ডিআরডব্লিউ কর্মীরা মাস শেষে বেতন পাচ্ছেন না। স্কুলে শিক্ষক নেই, হাসপাতালে ডাক্তার নেই। হাজার হাজার শিক্ষিত যুবক বেকার। এই পরিস্থিতিতে কয়েক ঘণ্টার আনন্দের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে শেষে লাঠিপেটা—এটাই কি উন্নয়ন?”
নবারুণ দেবের অভিযোগ, লাঠিচার্জ এখন বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার। তিনি বলেন, “যখন বেকার যুবকরা কাজের দাবিতে রাস্তায় নামে, তখন লাঠিপেটা। শিক্ষক-ছাত্রীরা দাবিতে নামলে লাঠিপেটা। আর এখন গান শোনার নাম করেও লাঠিপেটা। অর্থাৎ, লাঠি ছাড়া এই সরকার কিছুই বোঝে না।”
যুব কংগ্রেস নেতা আমির হোসেন এর প্রতিক্রিয়া ঃ –
কংগ্রেস নেতৃত্বও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। তাঁদের মতে, প্রমফেস্ট আসলে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি ছাড়া কিছুই নয়। কংগ্রেস নেতার বক্তব্য, “প্রমফেস্টের মূল উদ্দেশ্য বলা হয় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ফেস্টের মাধ্যমে রাজ্যের পর্যটন শিল্পের কী উন্নতি হয়েছে?”
তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় প্রতিবছর এই অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। অথচ সেই টাকা দিয়ে পর্যটন কেন্দ্র উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি—কিছুই করা হচ্ছে না। বরং ছাত্র-যুব সমাজকে ভুলিয়ে রাখার একটা চেষ্টা চলছে।”
কংগ্রেসের অভিযোগ অনুযায়ী, মাঠের ধারণক্ষমতা বিচার না করেই পাস বিলি করা হয়েছে। তিনি বলেন, “রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-যুব সমাজ এসেছে। পাস থাকা সত্ত্বেও তাদের উপর লাঠিচার্জ হয়েছে। সাংবাদিকরাও আক্রান্ত হয়েছেন। এমনকি মন্ত্রীদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তর্কে জড়াতে দেখা গেছে। এটা সরকারের চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।”
তিনি আরও বলেন, “বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—৫০ হাজার চাকরি, ফ্রি শিক্ষা, ল্যাপটপ, কলেজ—কিছুই পূরণ করেনি। তাই এখন উৎসব দিয়ে প্রশ্ন থেকে পালানোর চেষ্টা চলছে।”
সব মিলিয়ে প্রমফেস্টের ক্লোজিং প্রোগ্রামে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পরিকল্পনার অভাব এবং সরকারের দায়িত্বহীন মনোভাবকে নগ্নভাবে সামনে এনে দিয়েছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে যদি জনগণই নিরাপদ না থাকে, তবে সেই দায়িত্ব এড়ানোর কোনও সুযোগ নেই—এই প্রশ্নই আজ রাজ্যবাসীর মুখে মুখে।



