Sonamura Manik Sarkar : ত্রিপুরা ক্ষেতমজুর ইউনিয়নের দ্বাদশ রাজ্য সম্মেলনের সূচনা হলো শনিবার সোনামুড়া রবীন্দ্র চৌমুহনীতে এক প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে। দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে রাজ্যের আটটি জেলা থেকে প্রায় ৩৫০ জন প্রতিনিধি যোগ দেবেন বলে জানা গেছে। দুপুর দেড়টা নাগাদ শুরু হওয়া উদ্বোধনী সমাবেশে ছিলেন সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বসহ কৃষক-শ্রমিক সংগঠনের প্রবীণ প্রতিনিধিরা।
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিআইএম পলিটব্যুরোর সদস্য মানিক সরকার এই প্রকাশ্য সমাবেশে মূল বক্তার ভূমিকায় ছিলেন। তাঁর বক্তব্যে কেন্দ্রের বিজেপি পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানান তিনি।
মানিক সরকারের অভিযোগ—
“জাতপাতের রাজনীতি, বিভেদের আবহ তৈরি এবং কৃষি-শ্রমজীবী মানুষের সমস্যাকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র সরকার দেশে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। জনসভায় কৃষকের কথা বলা হলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।”
তিনি আরও দাবি করেন, উল্টো রেগা প্রকল্পের কাজ কমিয়ে দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা বিপন্ন করা হচ্ছে। তাঁর বক্তব্যে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতির বিরুদ্ধে অসম্পূর্ণতা, বঞ্চনা এবং ‘ফ্যাসিবাদী পরিবেশ’ তৈরির অভিযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রকাশ্য সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি রাধাবল্লভ দেবনাথ।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সম্পাদক শ্যামল দে এবং সর্বভারতীয় কৃষক নেতা ভানুরাল সাহা। সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির কনভেনর শ্যামল চক্রবর্তীও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশ শেষে সোনামুড়া টাউন হলে সম্মেলনের প্রথম দিনের কর্মসূচি শুরু হয়।
পরবর্তী অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মানিক সরকার অতীতের রাজনৈতিক ঘটনাবলি থেকে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনামূলক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তন, বামপন্থীদের উত্থান এবং ত্রিপুরার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি জানান—
বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার আগে ও পরে বিভিন্ন সন্ত্রাস, রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা সত্ত্বেও শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যের ভিত্তিতে বামপন্থী শক্তি যে প্রতিরোধ গড়েছিল, তা আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও প্রাসঙ্গিক।
মানিক সরকারের দাবি,
“দীর্ঘদিন ধরে শোষকেরা ক্ষমতায় থাকলেও তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্ষমতা ছাড়বে—এমন প্রত্যাশা ভুল। শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পরিবর্তনের একমাত্র পথ।”
তিনি সংগঠনগুলিকে জনগণের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশ করে আন্দোলনের ডাক দেওয়ার আহ্বান জানান—খেতমজুর ইউনিয়ন, কৃষক সংগঠন, উপজাতি পরিষদ, নারী সংগঠন, ছাত্র সংগঠন এসএফআই, যুব সংগঠনসহ তফসিলি সমন্বয় পরিষদকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে মত দেন।
সভায় তিনি রেশনিং ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁর দাবি—
রাজ্য জুড়ে রেশন দোকানের মাধ্যমে ভর্তুকিযুক্ত ন্যায্যমূল্যের পণ্য সরবরাহের যে ব্যবস্থা বামফ্রন্ট সরকার চালু করেছিল, তা আগের মতো কার্যকর নেই।
একইভাবে রেগা নিয়েও তাঁর অভিযোগ—
বাম সরকারের সময় যেখানে বছরে ৮০ থেকে ৯৪ দিন কাজ দেওয়া হতো, বর্তমানে তা নেমে এসেছে প্রায় ৩০–৩২ দিনে। মজুরি বৃদ্ধি, কাজের সময়মতো বরাদ্দ—এই ক্ষেত্রগুলোতেও অবহেলা চলছে বলে তাঁর মত।
মানিক সরকার প্রশ্ন তোলেন—
“কাজ কমে গেলে, আয় না থাকলে মানুষ বাজারে যাবে কী নিয়ে? উন্নয়ন দপ্তরগুলির মাধ্যমে কাজ সৃষ্টির যে সুযোগ ছিল, সেটিও এখন বন্ধ হওয়ার পথে।”
বক্তৃতার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা। কংগ্রেস সরকারের ভূমিকা, জমিদারি উচ্ছেদে ব্যর্থতা, বড় পুঁজিপতিদের সঙ্গে সমঝোতা এবং আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রভাবে অর্থনীতির দিক পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো তিনি বিশ্লেষণ করেন।
তিনি ব্যাখ্যা করেন—
যদি ভূমিহীনদের জমি বিতরণ করা হতো, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেত, গ্রামীণ মানুষের হাতে অর্থ আসত, বাজার বিস্তৃত হতো এবং শিল্প ও কর্মসংস্থানও বাড়ত। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে সেই সম্ভাবনা বাস্তব রূপ পায়নি।
কমিউনিস্টরা এই পরিবর্তনের জন্য লাগাতার চাপ সৃষ্টি করলেও, সরকার উল্টো পথে হেঁটেছে বলেও তাঁর অভিযোগ।
দুই দিনের এই সম্মেলনে ক্ষেতমজুরদের বিভিন্ন সমস্যা, রেগা-সংক্রান্ত দাবি, রেশনিং ব্যবস্থার উন্নতি, কৃষক-শ্রমিকদের একত্রিত আন্দোলনসহ একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতি ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষার দাবিতে কীভাবে লড়াই জোরদার করা যায়—তার রূপরেখা তৈরি করাই সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য।
সোনামুড়ার প্রকাশ্য সমাবেশে মানিক সরকারের ধারালো রাজনৈতিক বক্তব্যে যেমন বর্তমান নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ স্পষ্ট, তেমনি সংগঠনের ভরসার জায়গাটিও উঠে এসেছে—জনগণের সংগঠিত শক্তি।



