Tripura Congress News : ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ৪১তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ত্রিপুরা প্রদেশ কংগ্রেস ভবনে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হলো স্মরণ অনুষ্ঠান। সকাল থেকেই শহরের কংগ্রেস ভবনে জমায়েত হয় দলীয় নেতা, কর্মী সহ অন্যান্যরা।
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে। এরপর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি আশীষ কুমার সাহা দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং প্রয়াত নেত্রীর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মন, বিধায়ক গোপাল চন্দ্র রায়সহ প্রদেশ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব। সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
শ্রদ্ধানুষ্ঠানের পর নেতৃত্বরা শোভাযাত্রা করে আগরতলার গান্ধীঘাটে যান, যেখানে ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে ছিল দেশপ্রেম, আবেগ ও শ্রদ্ধার আবহ।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি আশীষ কুমার সাহা বলেন, “ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের শক্তি, ঐক্য ও উন্নয়নের প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বে ভারত আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়েছিল, আন্তর্জাতিক মঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল।”
১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর, আল্লাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন ইন্দিরা নেহরু। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর একমাত্র কন্যা হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও কেবল ‘নেহরুর মেয়ে’ হিসেবে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। শৈশব থেকেই তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল দেশের সেবা। তিনি ছিলেন ‘বানর সেনা’র প্রতিষ্ঠাতা, যা শিশু-কিশোরদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন, যারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বার্তা ও সংবাদ পৌঁছে দিত গোপনে।
বিদেশে পড়াশোনা করেও ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসা তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে গঠন করে।
১৯৪২ সালে তিনি ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীকালে রাজনীতির ময়দানে তাঁর উত্থান শুরু হয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসেন এবং ১৯৬৬ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।
ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত পায় এক দৃঢ়চেতা, বাস্তববাদী এবং সাহসী প্রধানমন্ত্রী। তাঁর অন্যতম সাফল্য ছিল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তাঁর অবদান তাঁকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, গোটা বিশ্বের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।
১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম ভূগর্ভস্থ পরমাণু পরীক্ষা ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ তাঁরই নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়। এটি প্রমাণ করে যে ভারত আত্মরক্ষায় সক্ষম একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ।
যদিও জরুরি অবস্থার সময় তাঁর প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, তবুও তিনি কখনও দেশের ঐক্য ও উন্নয়নের প্রশ্নে আপস করেননি। তাঁর নীতিগত দৃঢ়তা তাঁকে ‘আয়রন লেডি অফ ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত করেছে।
ইন্দিরা গান্ধী শুধু একজন রাজনীতিক নন; তিনি ছিলেন নারী শক্তির প্রতীক। এমন এক সময়ে যখন নারী নেতৃত্ব প্রায় অনুপস্থিত ছিল, তখন তিনি পুরুষ-প্রধান রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিলেন। তাঁর শাসনকালে নারী শিক্ষা, কৃষি উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নেওয়া নানা পদক্ষেপ আজও উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিনি বলতেন—*“আপনি যখন সঠিক কাজ করবেন, তখন কিছু মানুষ অবশ্যই আপনার বিরোধিতা করবে। কিন্তু মনে রাখবেন, ইতিহাস শেষ পর্যন্ত সত্যের পক্ষেই থাকে।”
বিশ্ব রাজনীতিতেও ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন প্রভাবশালী। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন, নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্টে ভারতের নেতৃত্বকে শক্তিশালী করেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর কূটনৈতিক বিচক্ষণতা তাঁকে ‘বিশ্বের সেরা মহিলা’ খেতাব এনে দেয় ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে।
১৯৭২ সালে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’-এ ভূষিত হন তিনি। একই বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর ভূমিকার জন্য মেক্সিকান অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান।
১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দিল্লিতে নিজেরই দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর মৃত্যু ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়। কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর দেশপ্রেম আজও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।



