The Bengal Files : ভারতের এক রাজনৈতিক দল কে ফায়দা দিতে একের পর এক বিতর্কিত চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলেছেন প্রসিদ্ধ পরিচালক বিবেক অগ্নি হোত্রী। যার ফলে দেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন , হিংসা , মারামারি সৃষ্টি সহ দেশের যে সমস্ত রাজ্যে বিরোধী রাজনৈতিক বিভিন্ন দল ক্ষমতায় রয়েছেন তাদের কে বেকফুটে নিয়ে যাবার ষড়যন্ত্র চলছে। বছর ঘুরতেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। তার ঠিক আগ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের কোটি কোটি মানুষের মস্তিস্কে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিষ ঢেলে দিতে আবারো সাদা পর্দায় মুক্তি পেল বিতর্কিত চলচ্চিত্র দা বেঙ্গল ফাইলস।
চলচ্চিত্র , কখনো বাস্তবের প্রেক্ষপটে আবার কখনো কল্পনার চরিত্র নিয়ে মানুষের হৃদয়ে , মননে , চিন্তনে ছাপ রেখে যাওয়ার মতো সাদা পর্দায় কয়েক ঘণ্টার কিছু অভিনয় – যা মানুষ দীর্ঘ দিন পর্যন্ত মনে রাখে। ভারতীয় চলচ্চিত্র কয়েক দশক যাবত দর্শক দের মনোরঞ্জন দিতে কঠোর পারিশ্রমিক দিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্যাটাগরি তে সিনেমা বানিয়েছে। তার কিছু দর্শক দের নজর কেড়েছে, কিছু আবার পারেনি। কিন্তু এর বাইরেও ভারতীয় সিনেমার একটা অংশ ভারতে জাতিগত, ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভেদ সৃষ্টি করার কারিগর হিসেবে কাজ করেছে । যার মূল কাণ্ডারি বিশিষ্ট পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী।
দা বেঙ্গল ফাইলস, ভারতের ইতিহাসে ভয়াবহ জেনোসাইড বা গনহত্যার ঘটনা। যা নিয়ে সম্প্রতি একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে নানা প্রেক্ষাগৃহে। ১৯৪৬ সালে অভিবক্ত বাংলার বুকে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ গণহত্যা কে ঘিরেই এই সিনেমা। ৫ই সেপ্টেম্বর ছবি টি মুক্তি পায়। আর সেদিন ই এই ছবি দেখার জন্যে প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমাতে দেখা যায় দেশের শাসক তথা অন্যতম রাষ্ট্রবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির তাবড় তাবড় নেতৃত্বদের। তারা দর্শক দের প্রতি বিশেষ ভাবে এই ছবি দেখার অন্যে আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে , কেন ?
আপনাদের দা কাশ্মীর ফাইলস ছবির কথা তো নিশ্চই মনে আছে। সেই ছবি নিয়েও বিজেপি একই ভাবে প্রচার করেছিল। দা কাস্মির ফাইলস ছিবি টির পরিচালক ও ছিলেন বিবেক অগ্নিহোত্রী। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, উনি দেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা জাতীয় ঘটনা বলি কে ঘিরে একের পর এক ছবি তৈরি করতে শুরু করেছেন।
দা বেঙ্গল ফাইলস ১৯৪৬ সালের ১৫ই আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের, তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কলকাতা শহরে হিন্দু ও মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি ভয়াবহ গনহত্যার ঘটনা। যেখানে বহু হিন্দু এবং মুসলিম উভয়েই প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু বিবেক অগ্নিহোত্রীর ছবিতে এই ঘটনার জন্যে সংখ্যালঘু মুসলিম দের কে নিশানা দেগে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করার মতো বার্তা পৌঁছে দেবার মতো তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
উল্লেখ্য বিষয়, ২০১৪ সালের পর থেকেই ইনি অর্থাৎ পরিচালক বিবেক বাবু দেশাত্মবোধক সিনেমা পরিচালনা করার আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। তার আগে অব্দি উনি যে সমস্ত ছবি তৈরি করেছেন তার সবকটিই এডাল্ট্রি , থ্রিলার এবং এন্টারটেইনমেন্ট জাতীয় ছবি ছিল। যেমন – হেট স্টোরি , চকলেট ডিপ ডার্ক, ধান ধানা ধান গোল, জিদ, জুনুনিয়ত ইত্যাদি। কিন্তু হঠাৎ করেই ২০১৪ থেকে উনার পরিচালিত ছবির তালিকা দেখলে যে কারো মনে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক।
বিজেপি , দেশের সর্ব বৃহৎ রাষ্ট্র বাদী এবং আরএসএস পরিচালিত দল যা হিন্দুত্ব কে প্রাধান্য দেয় সেই দলের ক্ষমতায় আসতেই এদিকে একে একে দেশের ইতিহাস ঘেঁটে হিন্দু মুসলিম এর আপেক্ষিক দ্বন্দ্ব কে সিনেমার আকারে প্রকাশ করতে শুরু করেন বিবেক। তার ছবি গুলিতে লিড রোলে স্থান পেয়েছে মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপম খের, দর্শন কুমার, পল্লবি জোশি। অনুপম খের যিনি নিজে বিজেপির একজন অন্যতম ভক্ত , মিঠুন চক্রবর্তী যিনি নিজে বিজেপির একজন সাংসদ। এরা প্রত্যেকেই বারংবার ঘুরে ফিরে এধরণের ছবি তে লিড রোল প্লে করছেন। এছাড়া অন্য কোনো নতুন মুখ কিংবা পুরনো কিংবদন্তী অভিনেতা বা অভিনেত্রী দের দেখা জাচ্চে না এধরণের ছবিতে। কারণ ভারতের সিনেমা জগতের বহু অভিনেতা এধরণের বিদ্বেষ মূলক ছবি কে প্রশ্রয় দিতে চান না বলেও তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
যাই হোক, এবার আশা যাক দা বেঙ্গল ফাইলস নিয়ে।
বেঙ্গল ফাইলস , ১৯৪৬ সালের আগস্ট এ ঘটে যাওয়া সেই গনহত্যার ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল কলকাতায়। এটি ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের কলকাতা শহরে মুসলমান ও হিন্দুদের বৃহত্তর সহিংসতার দিকে পরিচালিত করেছিল।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছায়। তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ক্লেমেন্ট অ্যাটলি যিনি ব্রিটিশ রাজের থেকে ভারতীয় নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে তিন সদস্যের মন্ত্রিসভা মিশন ভারতে প্রেরণ করেছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১ মে ভারতের গণপরিষদের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করার পরে এই ক্যাবিনেট মিশন ভারতের নতুন আধিপত্য এবং গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্রস্তাব দেয়।
মুসলিম লিগের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে ‘স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম’ রাষ্ট্রের দাবিতে প্রাদেশিক স্তর এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ‘’প্রদেশসমূহ’’ নামে একটি নতুন স্তর তৈরি করা হয়েছিল। এক সময়ের কংগ্রেস সদস্য এবং বর্তমানে মুসলিম লিগের নেতা কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলী হিসাবে ১৬ জুন ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।
তবে ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহেরু বোম্বাইয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেন যে, যদিও কংগ্রেস গণপরিষদে অংশ নিতে রাজি হয়েছে, তবে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাকে উপযুক্ত করতে সংশোধন করার অধিকার সংরক্ষণ করে। নেহ্রুর এই বক্তব্যের পরেই মুসলিম লিগের ভেতর এক আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে।
কেন্দ্রীয় সরকারে হিন্দু আধিপত্যের ভয়ে মুসলিম লিগের রাজনীতিবিদরা জিন্নাহকে “তার পূর্বের অনমনীয় অবস্থান” ফিরিয়ে নিতে বলেন। জিন্নাহ ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে গণপরিষদ বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে জিন্নাহ বোম্বাইয়ের (বর্তমান মুম্বাই) নিজ বাড়িতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে মুসলিম লিগ “সংগ্রাম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে” এবং তারা “একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে”। তিনি আরও বলেন যে, মুসলমানদের যদি আলাদা পাকিস্তান না দেওয়া হয় তবে তারা ‘সরাসরি পদক্ষেপ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের” ডাক দেবে।
১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম এর ডাক দেওয়া হয় এবং কলকাতা শহরে এক সুবিশাল জনসমাবেশ এর আয়োজন করে লীগ। সেখানকার মঞ্চ থেকেই প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত খাজা নাজিমুদ্দিন তার বক্তৃতার মধ্য দিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেন । হিন্দু রা মুসলিম দের উপর আক্রমণ করছে, এই বার্তা চারিদিকে ছড়িয়ে পরতেই মুসলিম রা উদ্দ্যত হয়ে আকরমন চালায়। প্রায় ১ সপ্তাহ ব্যাপি চলে এই গণহত্যা। যাতে অগণিত হিন্দু প্রাণ হারান। ততসঙ্গে বহু মুসলিম ও প্রাণ হারান।
এই নিয়ে বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় আর্টিকেল ছাপানো হয়েছে। একে দা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তবে এই ঘটনার পেছনে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা ছিল অত্যাধিক। কারণ পর্যাপ্ত সেনা বাহিনী থাকা সত্বেও এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনা দের মোতায়েন করা হয়নি বলে বিভিন্ন তথ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
এই ছিল কলকাতা দাঙ্গার পেছনের ঘটনা। কিন্তু দা কাশ্মীর ফাইলস এবং অন্যান্য ছবি গুলোর মতোই দা বেঙ্গল ফাইলস ছবি টিকেও দুই ভিন ধর্মের বিভেদ এবং সংখ্যা লঘু মুসলিম দ্বারা হিন্দু নিপীড়ন বলে আখ্যা দিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে বিভেদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবী উঠছে। এছাড়াও সিনেমায় বিভিন্ন ডায়লগ কে ঘুড়িয়ে পেচিয়ে এবং ভিন্ন রূপ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। যা সরাসরি বিদ্বেষ কে প্ররচিত করে।
মোদ্দা কথা, ভারতীয় সিনেমার অন্যতম পরিচালক বিবেক অগ্নি হোত্রী নিজের ব্যক্তিগত পছন্দের রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের বশীভূত হয়ে চলচিত্র কে ব্যবহার করে হিন্দু মুসলিম বিদ্বেশ কে প্ররচিত করার কাজ করে চলেছেন। যার প্রমাণ দা বেঙ্গল ফাইলস এর মতো ছবিগুলো। সেনসর বোর্ড এধরণের ছবি তে কিভাবে মুক্তি দেওয়ার অনুমতি প্রদান করে , সেটা নিয়েও বড় প্রশ্ন। কোটি কোটি দর্শকদের কে মনোরঞ্জন দেওয়ার জন্যে যে ভারতীয় সিনেমা সুনামের সাথে কাজ করে চলছিল , সেখানে বিবেক দের মতো লোকেদের কারণে রাজনীতির ছাপ পড়ছে, যা মোটেও দর্শক মহল ভালো ভাবে নিচ্ছেনা। এমনটাই গুঞ্জন।