Ujjayanta Palace Agartala Tripura
আজকের দিন দাঁড়িয়ে মাত্র ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কোনো প্রাসাদ তৈরি করার কথা আমরা হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন এই ১০ লক্ষ টাকার দাম ছিল অসামান্য। আর এই ১০ লক্ষ টাকা দিয়েই একটা গোটা প্রাসাদ নয়, বরং একটা সুদৃশ্য রাজ প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল উত্তর পূর্ব ভারতের একটি ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্যে। সেই রাজ্যের নাম ত্রিপুরা আর সেই রাজ প্রাসাদের নাম ‘উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ’।
১৮৯৯ থেকে ১৯০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন রাজন্য শাসিত ত্রিপুরার মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য ১০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে এই রাজ প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। যেখানে মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য , উনার স্ত্রী তিন মেইতেই মহারাণী ও ৬ জন মেইতেই রানী সহ গোটা পরিবার এই রাজ প্রাসাদেই ছিলেন। উনার পর পরবর্তী রাজা মহারাজা রাও এখান থেকেই রাজ্য শাসন করেছেন।
১৮৯৯ এ যখন এই প্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয় তখন তৎকালের ইংরেজ পরিচালিত মারটিন ও বার্ন কোম্পানি কে এই প্রাসাদ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১০ লক্ষ তথা ১ মিলিয়ন ডলারের মুল্যে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল ব্রিটিশ কোম্পানি মারটিন ও বার্ন।
এই প্রাসাদটি সম্পূর্ণ ভাবে শ্বেত বর্ণে রঞ্জিত। বিভিন্ন মিশ্র সংস্কৃতি ও স্থাপত্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রাসাদটি। প্রাসাদে তিন টি উঁচু গম্বুজ রয়েছে। তাঁর মধ্যে একেবারে মাঝখানে রয়েছে সর্বোচ্চ গম্বুজটি কার উচ্চতা প্রায় ৮৬ ইঞ্চি।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৬৩ সালে ত্রিপুরা ভারতের অঙ্গ হয় এবং ১৯৭১ সালে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। তখন ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে ভারত সরকার এর অন্তর্ভুক্ত ত্রিপুরা সরকার এই রাজ প্রাসাদটিকে মোট ২.৫ মিলিয়ন ডলারের পরিবর্তে রাজ পরিবারের কাছ থেকে ক্রয় করে নেয়। এর পর এটিকে রাজ্য সরকারের বিধানসভা কেন্দ্রে রুপান্তরিত করা হয়। পরবর্তী সময় বিধানসভা কেন্দ্রটি অন্যত্র স্থানন্তরিত করে এই রাজবাড়ী তথা উজ্জয়ন্ত প্রাসাদটিকে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্যের একটি অন্যতম যাদুঘর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যা বর্তমানে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার বুকে একটি অন্যতম সুদৃশ্য পর্যটন স্থল।
মিউজিয়ামের ভেতরে রাজন্য আমল ও ত্রিপুরার ইতিহাসের সাথে সংযুক্ত বহু জিনিস আজো যত্ন সহকারে সঞ্চিত রয়েছে। রাজন্য আমলের পয়সা, একটি বিশালকায় অজগর সাপের চামড়া , ত্রিপুরার বিভিন্ন জনজাতি সম্প্রদায়ের পোশাক ও গয়না ইত্যাদি নানা জিনিস রয়েছে এই যাদুঘরে। এছাড়া ত্রিপুরার প্রথম পত্রিকা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সৈনিকদের অবদান , রাজন্য আমলের জীবন যাপন ইত্যাদির ছবি ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ মিউজিয়ামের দেওয়ালে যত্ন সহকারে টাঙ্গানো আছে।
উল্লেখ্য, এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নামকরণ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর। মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের সাথে রবিঠাকুরের পরম সখ্যতা ছিল। ত্রিপুরায় মোট ৭ বার এসেছিলেন কবিগুরু। আর এই প্রাসাদের নাম উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ রাখার পেছনে ও উনারই কৃতিত্ব। ত্রিপুরা কে নিয়ে বহু কবিতা , গল্প, উপন্যাস ও নাটক লিখে গেছেন বিশ্ব কবি। যা আজো পাঠকদের হৃদয়ে এক অনন্য স্থান জুড়ে আছে।
উজয়ন্ত প্রাসাদ টি সময়ের সাথে সাথে পর্যটকদের আকর্ষিত করার লক্ষ্যে আরও অনেকটাই সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রাসাদের দুই পারে দুই জাগ্রত মন্দির, যার একটি লক্ষ্মী নারায়ন মন্দির এবং অপরটি জগন্নাথ দেবের মন্দির। বলা হয়, মহারাজা এমনভাবেই এই প্রাসাদ ও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যাতে প্রাসাদের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের দর্শন করা যায়।
অন্যদিকে রাজপ্রাসাদ থেকে সোজা তাকালে তৎকালে চোখে পড়তো মহারাজগঞ্জ বাজার। রাজন্য আমলের সর্ব বৃহৎ বাজার যা আজকের দিনে দাড়িয়েও আগরতলা শহরে সব চাইতে বড় পাইকারি বাজার বলে পরিচিত।
এতো সুন্দর একটি পর্যটন স্থলে যেতে কার না মন চাইবে? আর অবশ্যই প্রাসাদের এই অপরূপ মহিমা ও কৃতিত্ব গুলিও ক্যামেরা বন্দী করতে ইচ্ছে জাগবে নিশ্চিত। তবে এই প্রাসাদের ভেতরে ছবি তোলা, ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তবে বাইরে ছবি তোলা যেতে পারে। রাজ্যের এই অপরূপ স্থলটি কে এক নজর দেখতে বহু দেশ বিদেশ থেকেও পর্যটকদের আগমন ঘটে এখানে। আর সেটাই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই পর্যটন স্থলের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওনা।