Bhuvaneshwari Temple
ত্রিপুরা রাজ্য বরাবরই এক বিচিত্র জায়গা। যেখানে ভারতের রাজন্য আমলের বহু অজানা তথ্য লুকায়িত আজো। দেশের রাজন্য শাসিত প্রদেশ গুলোর মধ্যে একটি ছিল এই ত্রিপুরা রাজ্য। দেশ বিভাজনের পূর্বে ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের ও বহু স্থান যুক্ত ছিল। তৎকালে ত্রিপুরার রাজন্য পরিবার গোটা ত্রিপুরা সমেত বাংলার বহু অঞ্চলে রাজত্ব করে গেছেন। সেই রাজন্য আমলের বহু ইতিহাস আজো অক্ষত অবস্থায় আছে। আবারো বহু ইতিহাস মাটির নিচেই দেবে থেকে গেছে যা ঐতিহাসিক কিংবা প্রত্নতত্ত্ব বিদদের দ্বারা ও এখনো উদ্ঘাটন করা হয়নি। এমনই অর্ধ উন্মোচিত ইতিহাসে আবৃত এক ঐতিহাসিক স্থান মন্দির নগরী উদয়পুরের ভুবনেশ্বরী মন্দির তথা প্রাচীনতম রাজবাড়ী।
আগরতলা শহর থেকে প্রায় ৫৫কিমি দূরত্বে গোমতী জেলার উদয়পুর মহকুমা স্থিত রাজনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে এই প্রাচীনতম রাজবাড়ীর অবস্থান। আগরতলা থেকে সেখানে পৌছাতে আনুমানিক ঘণ্টা দুয়েকের মতো সময় লাগে।
রাজবাড়ীর ইতিহাস
ত্রিপুরায় দীর্ঘ ৩০০০ বছরের ও বেশি সময় ধরে মানিক্য তথা ইন্দো মঙ্গোলীয় বংশজ মানিক্য উপাধি প্রাপ্ত রাজা মহারাজা রা রাজত্ব করেছিলেন। এক সময় ত্রিপুরার সমস্ত রাজ কাজ এই ভুবনেশ্বরী মন্দির তথা রাজ বাড়ি থেকেই পরিচালিত হতো। রাজা, রানী, রাজপরিবার, সৈনিক, দাস দাসী থেকে শুরু করে সকলের বসবাস ছিল এখানেই। ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মানিক্যের আমলে এখান থেকে রাজপাঠ সামলানো হতো বলে জানা যায়। দীর্ঘ বহু শতক যাবত পরিত্যেক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে এই রাজ বাড়ির অর্ধেকের ও বেশি অংশ এখনো মাটির তলাতেই শায়িত রয়ে গেছে। জানা যায় গোটা রাজ প্রাসাদ টি ছিল ৭ তলার। তার মধ্যে উপরএর দুটি তলা উদ্ধার করেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিদ রা বাকি আরও ৫ তলা আজো মাটির নিচেই চেপে আছে বলে স্থানীয়দের মতামত।
রবীন্দ্রনাথ ও ভুবনেশ্বরী মন্দির
রাজ বাড়িতে প্রবেশের শুরুতেই চোখে পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের একটি পাথরের মূর্তি। ১৪২১ বাংলা সালের ২৫শে বৈশাখ এই মূর্তি টি এখানে স্থাপন করা হয়। মূর্তি টি দেখেই অনুমান করা যায় যে এই রাজবাড়ীর সাথে কবিগুরুর একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তৎকালে মহারাজা গোবিন্দ মানিক্যের সঙ্গে রবীন্দ্র নাথের বড্ড নিবিড় সম্পর্ক ছিল। যদিও তিনি তৎকালে ভুবনেশ্বরী মন্দিরে আসেননি। শুধু মাত্র কল্পনার আদলেই তখন মহারাজা গোবিন্দ মানিক্য এবং ভুবনেশ্বরী মন্দির ও পুরাতন এই রাজবাড়ী নিয়ে একটি উপন্যাস এবং নাটক রচনা করেছিলেন রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর। সেই উপন্যাস এর নাম ছিল “রাজর্ষি” আর নাটকের নাম ছিল “বিসর্জন”।
”এতো রক্ত কেন?” – উক্তির তাৎপর্য
কবিগুরু যখন রাজর্ষি নামক উপন্যাস টি রচনা করেন ১৮৮৭ সালে। উপন্যাস টি ত্রিপুরার রাজপরিবার ততসঙ্গে ধর্মীয় এবং কুসংস্কার নির্মূলীকরণের জন্যে রচিত হয়। কাল্পনিক হলেও উপন্যাস টি হৃদয় ছুয়ে যায় সকলের। সেই উপন্যাসে কবি গোবিন্দ মানিক্য এবং দুই শিশু কে কেন্দ্র করে এক পরিস্থিতির চিত্র প্রদর্শন করেন। যাতে লেখা ছিল, একদা সকালে মহারাজা গোবিন্দ মানিক্য গোমতী নদীতে স্নান করতে যান । সেখানে গিয়ে হাসি ও তাতা নামের দুই ভাইবোন কে খেলা করতে দেখতে পান তিনি। রাজার সাথে এই দুই ভাইবোনের খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। একদিন নদীর ধারে যাবার পথে তারা দেখতে পান যে নদীর ঘাটে রক্তের দাগ। তখনই হাসি প্রশ্ন করে, “এতো রক্ত কেন?” ।
রাজা তখন ছোট্ট হাসির কথার জবাব দিতে পারেনি। তাই হাসি নিজের আচল দিয়ে ঐ রক্তমাখা নদীর ঘাট মুছতে থাকে। এর পরেই হাসির তীব্র জ্বর হয়। আর জ্বরের ঘোরে হাসি বারবার একই কথা বলতে থাকে “এখানে এতো রক্ত কেন?”। তারপর হাসির মৃত্যু হয়। উক্ত ঘটনা রাজা গোবিন্দ মানিক্যের মনে এতটাই দাগ কাটে যে তিনি সাড়া প্রদেশ জুড়ে বলি প্রথা বন্ধ করে দেবার আদেশ দেন। বলি প্রথা বন্ধের প্রতিবাদ করে রাজা ও তার পুরোহিত বিল্বন কে রাজ্য ছাড়া করেন গ্রামের মানুষ ।কিন্তু শেষ অব্দি কবিগুরুর কাহিনীতে দেখানো হয় যে মানুষ বলি প্রথার মর্মান্তিক পরিণতি উপলব্ধি করেন এবং রাজা ও বিল্বন এর মতাদর্শের সাথে মানবতার ও জয় হয়। এভাবেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশের পরিণতি ঘটিয়ে ত্রিপুরার মানুষের বলি প্রথার বিরুদ্ধে জাগ্রুক হবার উদ্দেশ্যে এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তি দেবার উদ্দেশ্যে রচিত হয় এই “রাজর্ষি” নামক রচনা।
রবীন্দ্র নাথ ৭ বার ত্রিপুরায় এসেছেন। কিন্তু তিনি কখনোই এই পুরাতন রাজবাড়ীতে যাননি। তথাপি উনার উপন্যাস এবং নাটক পড়লে মনে হয় যেন বাস্তবের উপলব্ধি হচ্ছে। যদিও বাস্তবে এধরণের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে তথ্য নেই।
প্রাচীনতম রাজবাড়ীর গঠন
রাজ বাড়িটির যতটা অংশ উদ্ধার করা গেছে তার মধ্যে রাজন্য আমলের বৈঠক ঘর , পাক ঘর ইত্যাদি স্থান গুলির হদিশ মিলেছে। যেখানে দেখা যায় বিশাল বিশাল চুল্লি র ব্যবস্থা ছিল । হাজার হাজার রাজ পরিবার ও সৈন্য সামন্তের জন্যে রান্না বান্না হতো এই পাক ঘর গুলিতে। তাছাড়া প্রাসাদের দেওয়াল ঘিরে বহু চিত্র অঙ্কিত আছে। যা কালের বিবর্তনের সাথে আর দীর্ঘদিন মাটির নীচে চাপা পড়ে অনেকটা ক্ষয় হয়ে গেছে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বিদদের দ্বারা উদ্ধার করার পর কিছু কিছু ভগ্নাংশ গুলিকে মেরামতি করা হয়েছে। হাজার বছর পুরনো এই রাজ বাড়ি বর্তমানে গোমতী জেলার মানচিত্রে একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। যেখানে রোজ বহু পর্যটকের আনাগোনা লেগে থাকে।
গোমতী নদী ও রাজপ্রাসাদ
প্রাসাদের একেবারে গা ঘেসেই বয়ে চলেছে গোমতী নদী। বলা হয়ে থাকে গোবিন্দ মানিক্যের আমলে এখানে যে পশু বলির প্রথা ছিল তখন সমস্ত বলির রক্ত এই গোমতী নদীর জলে গিয়ে মিশে যেত। কিছুটা ঢালু প্রকৃতির সরু পথ নদীর সাথে মিলিত হয়েছে এখানে। যা ইঙ্গিত করে তৎকালে বলির রক্তের ধারা বয়ে যেত এই পথ ধরেই।
ভুবনেশ্বরী মন্দির
এই স্থানের সর্বাধিক আকর্ষণীয় স্থান ভুবনেশ্বরী মন্দির। রাজা এখানে নিত্য দেবী ভুবনেশ্বরির আরাধনা করতেন। যদিও প্রাচীন মন্দির গুলির ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ায় পরবর্তী কালে দর্শকদের আকর্ষিত করতে এবং মন্দিরের উপস্থিতির জানান দিতে এখানে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। এছাড়া একটি আলাদা মন্দির রয়েছে যেখানে এখনো দেব দেবীর মূর্তি স্থাপিত আছে আর পুরোহিত এখানে নিত্যদিন পূজার্চনা করেন। আশে পাশে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশের ছোঁয়ার আনন্দ উপভোগ করতে ও পর্যটকদের আগমন ঘটে এখানে। তাছাড়া এই পুরনো রাজবাড়ী ত্রিপুরার রাজন্য আমলের ইতিহাস বহন করে। তাই শিশু থেকে বৃদ্ধ , সকল অংশের মানুষই এখানে পর্যটন করতে আসতে পছন্দ করেন।
প্রাসাদের গায়ে খোদাই করে এবং টাইলস এ লিখনের মধ্যে দিয়ে এই প্রাসাদ ও ভুবনেশ্বরী মন্দির নিয়ে গোটা ইতিহাস উল্লেখ করা আছে। তবে এই রাজ প্রাসাদের সেই রক্ত মাখা ইতিহাস এর লেখাঝকা নেই কোথাও। স্থানীয় লোকজনদের কাছ থেকে কিছু কিছু তথ্য মিললেও রাজর্ষি উপন্যাস না পড়লে এই স্থানের বিষয়ে কৌতূহল জাগাটা কিছুটা অসম্ভব। যদিও রাজ্যের মানুষ এই প্রাচীনতম প্রাসাদের ইতিহাস নিয়ে অনেকটাই জানেন। তবে বহিঃ রাজ্যের পর্যটকদের কাছে অনেক তথ্যই অজানা থেকে যায়।
তবে আজো এই স্থান টি নিশুল্ক । এখানে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো রূপ টিকিট কাটতে হয়না ।কিংবা ছবি তোলা বা ভিডিও করার ক্ষেত্রে ও বাঁধা বিপত্তি না থাকায় অবাধে পর্যটকেরা এই স্থানে এসে নিজের জীবনের একটা খালি সময় অতিবাহিত করতে পছন্দ করেন। ত্রিপুরার প্রাচীনতম পর্যটন স্থলগুলোর মধ্যে একটি এই প্রাচীন রাজ প্রাসাদ। যা রাজন্য আমলের ঐতিহ্য সহ রাজ্যের পুরাতন ইতিহাস কে ও যুগ যুগান্তর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে। প্রত্নতত্ত্ব বিদেরা প্রয়াস চালালে মাটির তলায় শায়িত আরও সেই ৫ তলা উদ্ধার করা সম্ভব বলেও মনে করেন পর্যটকেরা। আর যদি তা হয় তবে এই প্রাসাদের আরও বহু ইতিহাস উন্মোচিত হবে বলেও ধারণা করা হয়।