Minister Tinku Roy
গরীব দুঃস্থ পরিবারের পাশে দাঁড়ানোই নয়, এবার নিজের ব্যক্তিগত অর্থ খরচ করে এক হতদরিদ্র মা বাবার একমাত্র ছেলে কে রাজ্যে ফেরালেন মন্ত্রী টিংকু রায়। আক্ষেপ একটাই, তাকে জীবিত ফেরাতে পারলেন না। ঘটনা কৈলাসহরের দেবস্থল এলাকায়।
কৈলাসহরের দেওরাছড়া এডিসি ভিলেজের চার নং ওয়ার্ডের দেবস্থল গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী বীরবল তাঁতী এবং উনার স্ত্রী ৬৫ বছরের গীতা তাঁতী। উনারা দুজনই বৈষ্ণব এবং বৈষ্ণবী। দেবস্থল এলাকায় উনাদের নিজ বাড়িতে জগন্নাথ মহাপ্রভুর একটি মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরে বিগত ত্রিশ বছর ধরে উনারা দুজন নিয়মিত ভাবে পূজা পাঠ করে যাচ্ছেন। এই দম্পতির জীবন যাপনের একমাত্র ভরসা দান দক্ষিণা। এই দিয়ে কি আর জীবন চলে ? তাই উনাদের একমাত্র ছেলে নেপাল তাঁতি মা বাবার দুঃখ ঘোচাতে পাড়ি দিলেন সুদূর ব্যাঙ্গালোরে। সেখানে একটি বেসরকারি কোম্পানি তে সিকিউরিটি গার্ড এর চাকরি করতেন নেপাল। বিগত এক বছর ধরে ব্যাংগালোরের সেই এক বেসরকারি সংস্থার সিকিউরিটি গার্ড হিসেবেই কাজ করতো এবং নেপাল ব্যাংগালোরে একাই থাকতো। বিগত কিছুদিন পূর্বে নেপাল ব্যাংগালোরে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে যায়। তার শারিরীক অবস্থা চূড়ান্ত খারাপ হয়ে যাওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য নেপাল ব্যাংগালোরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যায়। অসুস্থতার খবর এবং বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির খবর নেপাল নিজেই তার বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিলো নিজের মা বাবা কে। এই শুনে তারা বরাবরই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু তারা তখনও বুঝতে পারেননি যে এর চাইতে ও বড় আঘাত তাদের জন্যে অপেক্ষমাণ ছিল।
বেসরকারি হাসপাতালে চার দিন থাকার পর নেপালের মৃত্যু ঘটে। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নেপালের মৃত্যুর খবর নেপালের মা গীতা তাঁতীকে ফোন করে জানায়। ছেলের মৃত্যুর খবর পেতেই গীতা দেবীর পৃথিবী যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কিন্তু নিরুপায় মা, অসহায় হতদরিদ্রা কি করবেন ? কারন, গীতা দেবীর পারিবারিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, উনারা রেলের টিকিট ক্রয় করে ব্যাংগালোরে গিয়ে ছেলের মৃতদেহটুকু যে দেখবেন সেই সামর্থ্য ও তাদের নেই। মৃত ছেলের মুখটা শেষবারের মতো দেখার জন্য লাগাতর দুই দিন গীতা দেবী বাড়িতে বসে কাঁদছিলেন। কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী টিংকু রায়ের কাছে গীতা দেবী নিজেই ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে ঘটনাটি জানান এবং ছেলের মৃতদেহ বাড়ি ফেরাতে মন্ত্রীর সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
এরপর মন্ত্রী টিংকু রায় নিজেই ব্যাংগালোরের বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী টিংকু রায়কে ব্যাংগালোরের বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় যে, মৃত নেপাল তাঁতীর চিকিৎসা বাবদ প্রায় এক লক্ষ সাত হাজার টাকা হাসপাতালে বকেয়া রয়েছে। এই বকেয়া টাকা না মেটালে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতদেহ হস্তান্তর করতে পারবেন না। পরবর্তী সময়ে বকেয়া সেই এক লক্ষ সাত হাজার টাকা মন্ত্রী টিংকু রায় নিজের ব্যক্তিগত কোষ থেকেই দিয়ে দেন ব্যাংগালোরের বেসরকারি হাসপাতালে এবং মন্ত্রী টিংকু রায় নিজের আরও টাকা খরচ করে মৃতদেহ ব্যাংগালোর থেকে বিমানে করে আগরতলায় আনেন। আগরতলা বিমানবন্দর থেকে গাড়ি দিয়ে কৈলাসহরের দেবস্থল এলাকায় গীতা দেবীর নিজ বাড়িতে মৃতদেহ পৌঁছে দেন তিনিই। একথা মন্ত্রী টিংকু রায় নিজেই গীতা দেবীর বাড়িতে বসে মৃতদেহ আনার পর জানিয়েছেন। পাশাপাশি মন্ত্রী টিংকু রায় একথাও জানান যে, এই কাজ করে কতটুকু ভালো করেছেন তা উনি জানেন না। কারণ, গীতা দেবীর জীবন্ত ছেলেকে ব্যাংগালোর থেকে এনে দিতে পারেন নি তিনি এইটুকুই আক্ষেপ থাকবে। তবে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন নেপালের মৃতদেহ যে করেই হোক গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তবে, রাজ্যের যুবক যুবতীদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, বহিঃরাজ্যে কাজে যেতে হলে যে সংস্থার অধীনে কাজে যাবেন সেই সংস্থা সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে যাবার জন্য। কারন, নেপাল তাঁতী যদি ভালো সংস্থার অধীনে কাজ করতো তাহলে চিকিৎসার জন্য নেপালের মৃত্যু হত না এবং মৃত্যু হলেও মৃত্যুর পর মৃতদেহ সংস্থার পক্ষ থেকে বাড়িতে পৌঁছে দিত
নেপালের মৃতদেহ বাড়িতে পৌঁছা মাত্রই বাড়িতে ভিড় জমে যায় এবং গোটা গ্রামে কান্না শুরু হয়ে যায়। নেপাল দেবস্থল গ্রামের সবার কাছে খুবই প্রিয় ছিলো। নেপালের মৃত্যু হয়েছে সেটা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি এবং ব্যাংগালোরে নেপাল তাঁতীর মৃত্যুর পর নেপালের মৃতদেহ গ্রামবাসীরা দেখতে পারবে সেটা দেবস্থল গ্রামের মানুষের কাছে অলৌকিক স্বপ্নের মতো ছিলো। অন্যদিকে, অসহায় নিরীহ দুঃস্থ গরীব ৬৫বছরের গীতা তাঁতী নিজেই জানান যে, উনি ভেবেছিলেন নিজের ছেলের মৃতদেহটা এবং ছেলের মুখটা শেষবারের মতো আর কোনো দিন দেখতে পারবেন না। এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী টিংকু রায়ের কল্যানে। এই কাজের জন্য গীতা দেবী মন্ত্রী টিংকু রায়ের দীর্ঘায়ু কামনা করেন এবং মন্ত্রীকে ভগবান বলেও সম্বোধন করেন গীতা তাঁতী। সত্যিকারের অর্থেই একজন মায়ের কাছে এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হয়না। নেপালের মৃতদেহ বাড়িতে এনে দেওয়ার পর মন্ত্রী টিংকু রায় মৃত নেপালের স্ত্রীর হাতে নগদ টাকা তোলে দেন শ্রাদ্ধানুস্টান সহ সামাজিক কাজকর্ম করার জন্য। এছাড়াও গরীব দুঃস্থ অসহায় গীতা দেবীর পরিবারের পাশে দাঁড়ান মন্ত্রী টিংকু রায়।
মৃত নেপাল তাঁতীর একমাত্র সাত বছরের মেয়ের বিনামূল্যে থাকা খাওয়া এবং পড়াশোনার জন্য হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন এবং আগামী এক মাসের মধ্যে নেপালের স্ত্রীর বিধবা ভাতা ও মৃত নেপাল তাঁতীর মা ৬৫বছরের গীতা তাঁতীর বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করে দেন মন্ত্রী টিংকু রায়।
রাজনৈতিক আঙ্গিকে দল কিংবা মন্ত্রী হিসেবে হয়তো অন্যদের মতো মন্ত্রী টিংকু রায় ও অনেকের কাছেই অপ্রিয় হতে পারেন। কিন্তু এই নজির গড়ার পর উনার প্রতি রাজ্যের মানুষ শ্রদ্ধালু দৃষ্টি প্রদর্শন করবেন এটা আলাদা ভাবে ভাবার প্রয়োজন পরে না।